বাংলাদেশের সর্ব উত্তরে অবস্থিত পঞ্চগড় জেলা যা ঢাকা শহর থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। প্রাচীন ইতিহাস আর ঐতিহ্যের অগণিত স্মৃতি এবং হাজার বছরের গৌরবগাথার সমনয়ে গঠিত আমাদের এই পঞ্চগড়। সবচেয়ে মজার বিষয় হল, পঞ্চগড় হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত আর এই ভৌগলিক অবস্থানের কারণে পঞ্চগড়কে বলা হয় হিমালয় কন্যা।
সময়ের সাথে সাথে বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে উঠছে এই জেলাটি। আর হবেই না কেন? অসম্ভব সৌন্দর্যের লীলাভূমি এ জেলাটিতে আসলে আপনি খালি চোখেই উপভোগ করতে পারবেন বিশ্বের তৃতীয় সবোর্চ্চ পবর্তশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘার মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। কাঞ্চনজঙ্ঘা-এর পাশা পাশি আরো উপভোগ করতে পারবেন পাহাড়ি ঢল থেকে নেমে আসা স্বচ্ছ জলাধারার নদী, সমতল ভূমির চা-বাগান, বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল আর প্রাগৈতিহাসিক নানা স্থাপনা আর দুর্গ সহ আরো অনেক কিছু।
পঞ্চগড় থেকে ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকার ফাকা জায়গা থেকে খুব সকালে মেঘ আর কুয়াশামুক্ত নীল আকাশে আপনারা উপভোগ করতে পারবেন এই মনোরম দৃশ্য। তবে সবচেয়ে ভাল ভিউ পেতে হলে আপনাকে চলে যেতে হবে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার বাংলাবান্ধাতে কিংবা তেঁতুলিয়া ডাকবাংলোতে। সেই সাথে তেঁতুলিয়ার বাইপাস কিংবা ভজনপুরের করতোয়া সেতু থেকেও দেখা যায়।
তাছাড়া সুউচ্চ এই মনোরম চূড়া দেখতে দেশ এবং বিদেশ থেকে অসংখ্য টুরিষ্ট ছুটে যান ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অবস্থির দার্জিলিং শহরের টাইগার হিল পয়েন্ট এ। কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ার আসল সৌন্দর্য দেখার সবচেয়ে আদর্শ জায়াগ এটি। আবার অনেকেই সরাসরি নেপালে গিয়েও এই কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্যবেক্ষণ করে থাকেন।
সর্ব উত্তরে আর হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থানের কারণে পঞ্চগড় শীতপ্রবণ জেলার অন্তর্গত। অক্টোবর এর মাঝামাঝি সময় থেকেই শীত বাড়তে থাকে এই অঞ্চলে। এমনকি নভেম্বর থেকে শুরু করে মাঝ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রচন্ড কুয়াশাসহ শীত পড়ে। শীত এবং কুয়াশার তীব্রতা এতটাই থাকে যে নভেম্বর থেকে জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত এখানকার তাপমাত্রা গড়ে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে। মাঝে মাঝে শীতের তীব্রতা এতটাই থাকে যে তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস এ নেমে পড়ে।
এই পর্বতচূড়ার দেখা পেতে হলে যাত্রা শুরু করতে হবে পঞ্চগড়ের পথে। বাস, ট্রেন এবং প্লেন- তিনটির যেকোনোটি বেছে নিতে পারেন যাত্রার মাধ্যম হিসেবে। বাসে চড়ে আপনাকে প্রথমে যেতে হবে পঞ্চগড় আর ঢাকা থেকে পঞ্চগড়ের এর রুটে এসি কিংবা নন এসি বাস পাওয়া যায়। বিরতিহীন যাত্রা এবং সহজপ্রাপ্য হওয়ায় অনেকেই বাসেই সচরাচর ভ্রমণ করে থাকেন। তবে সপরিবারে ভ্রমণের জন্য অনেকেরই পছন্দ ট্রেন। কিছুটা আরামদায়ক হওয়ায় এবং বাড়তি সুবিধা থাকায় ট্রেন আজকাল বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। পঞ্চগড় পৌঁছানোর পর সেখান থেকে আপনাকে ধরতে হবে তেঁতুলিয়ার রাস্তা। তার জন্য রয়েছে কয়েকটি নিয়মিত লোকাল বাস। তবে ট্রেনে কিংবা বাসে, যেভাবেই যান না কেন ঢাকা থেকে যেতে সময় লাগবে গড়ে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা। তাছাড়া দীর্ঘ পথ, সাথে জ্যাম কিংবা ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয়ে পোহাতে হয় বিশাল ঝামেলা। এই ক্ষেত্রে বর্তমানে, প্লেন জার্নি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ঢাকা থেকে সকালের ফ্লাইট ধরে চলে যেতে হবে সৈয়দপুর যার যাত্রা সময় ৫০ থেকে ৫৫ মিনিট। এরপর সেখান থেকে প্রাইভেট কার কিংবা মাইক্রতে চড়ে ২ ঘণ্টার মধ্যে পৌছে যান আপনার গন্তব্য পঞ্চগড়ে। মূলত এই ট্রাভেল চয়েজটা পুরোপুরি ডিপেন্ড করে আপনার ইচ্ছা, ট্রাভেল বাজেট আর অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার উপর।
তেঁতুলিয়ার মহানন্দা নদীর তীরে আছে পঞ্চগড়ের ডাকবাংলো। তবে এই ডাকবাংলােতে থাকতে হলে আপনাকে আগে থেকে তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার পারমিশন নিতে হবে। আগে এই বাংলোতে থাকতে হলে, প্রতি কক্ষের জন্য গুনতে হতো ৮০০ টাকা। ডাকবাংলোর পাশাপাশি আছে বন বিভাগের রেস্টহাউজ, বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরেও জেলা পরিষদের ডাকবাংলাে, ডিসি বাংলাে, সিমান্ত পার, কাজী ব্রাদার্স আবাসিক হােটেল ইত্যাদি। তবে আপনি যদি ভাল মানের হোটেল কিংবা রিসোর্ট এ থাকার প্ল্যান থাকে, তাহলে আপনাকে চলে যেতে হবে রংপুরে। হোটেল গ্র্যান্ড প্যালেস কিংবাঁ নর্থ ভিউ হোটেল এ পেয়ে যাবেন আপনার পছন্দের সব সুযোগ-সুবিধা রুম। এখানে আপনি আপনার পছন্দ মত ভাল মানের হোটেল কিং রিসোর্ট এ সপরিবারে থাকতে পারবেন।
সূর্যোদয়ের পর থেকেই সকলের চোখে খুব মনোরমভাবে ধরা পরে কাঞ্চনজঙ্ঘার নয়নাভিরাম রূপ। প্রকৃতির নৈসর্গিক এ রূপ যেকোনো ভ্রমণপিপাসুর মনে স্থান করে নিয়ে বাধ্য। চোখে দেখা এই রূপ দেখে সব ভ্রমণপিপাসুদের মনে স্থান করে নিয়ে বাধ্য। কেনই বা হবে না? এরকম তুষারশুভ্র পাহাড়ের চূড়ায় পড়া সূর্যের প্রথম কিরণ যে রূপ প্রকাশ করে তার তুলনা কোন কিছুর সাথেই সম্ভব নয়। । যতই সূর্যের কিরণ আর তেজ বাড়তে থাকে, কাঞ্চনজঙ্ঘা আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বেলা ১০ থেকে ১১ পর্যন্ত এই রূপ খুব সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে আর এরপর সময়ের সাথে সাথে ক্রমান্বয়ে আবার ঝাপসা হয়ে হারিয়ে যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা। তবে শেষ বিকেলে সূর্যকিরণ যখন তির্যকভাবে বরফাচ্ছাদিত পাহাড়ে পড়ে তখন অনিন্দ্য সুন্দর হয়ে আবারও ধরা দেয় কাঞ্চনজঙ্ঘা। শেষ বিকেলের কাঞ্চনজঙ্ঘার এই রূপ সকলকে মুগ্ধ করে আর তা দেখার জন্য উপস্থিত হয় প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের দল।
পঞ্চগড়ে খালি চোখে কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শন করেই যে ঢাকা চলে আসতে হবে, এমনটা নয় কিন্তু। এর পাশপাশি আপনার পঞ্চগড় ভ্রমণকে সাজিয়ে নিতে পারেন অন্যান্য টুরিষ্ট প্লেসে যেয়ে। এর মধ্যে অন্যতম হলঃ , তেঁতুলিয়া জিরো পয়েন্ট, সমতল ভূমির আরগনিক চায়ের বাগান, শাহী মসজিদ, বারো আউলিয়ার মাজার, বাংলাবান্ধা জিরো (০) পয়েন্ট ও বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর, ভিতরগড় ও মহারাজের দীঘি, আনন্দ ধারা, কাজী অ্যান্ড কাজী টি, তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো, পাথর সমৃদ্ধ রকস মিউজিয়াম, তুর্থ চীন বাংলাদেশ মৈত্রী সেতুসহ আরো অনেক কিছু।
চা বাগানের কথা শুনার সাথে সাথে আমরা নিজের অজান্তেই চলে যাই চায়ের রাজধানী শ্রীমঙ্গল কিংবা সিলেট। উঁচু নিচু সবুজে ঘেরা টিলা-পাহাড় তার গায়ে সারি সারি চা গাছ। কিন্ত সমতল ভুমিতেও চায়ের চাষ হয় আর গড়ে উথে সারি সারি চা বাগান, যা পঞ্চগড় না এলে বোঝা যাবে না। বাংলাদেশে একমাত্র পঞ্চগড় জেলাতেই অর্গানিক ও দার্জিলিং জাতের চায়ের চাষ হয় এবং ইতিমধ্যে তা বাংলাদেশের বাইরে বেশ সুনাম অর্জন করেছে। পঞ্চগড় জেলাতে এরকম অনেক অর্গানিক চায়ের প্রাণজুড়ানো সবুজ বাগান উপভোগ করতে পারবেন।
সারাদিন বেশ সুন্দর সময় চা বাগানে কাটালেও, সন্ধ্যার পরে এসব চা বাগানের নেমে আসে ভিন্ন এক স্বগীয় সৌন্দর্য। সন্ধ্যার পরে যখন চাঁদের আলোতে পুরো চা বাগান আলোকিত হয় তখন মনে হবে আপনি যেন ভেসে বেড়াচ্ছেন নীল পরীর দেশে। চাঁদের আলো পড়ে চা বাগানে যে মায়াবী রূপ সৃষ্টি হয় তাকে আরো এক ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে যান জোনাকি পোকারা, যা চা বাগানকে সাজায় আপন মনে। আপনার মুহূর্তে মধ্যে মনে হবে যেন আপনি কোন এক রুপকথার দেশে এসে পরেছেন। সময় করে এসব চা বাগানে ঘুরে আসলে অবশ্যই ভাল লাগবে আপনার এবং পরিবারের সকলের৷
পঞ্চগড় জেলায় আরো আছে শত শত বছরের পুরনো অনেক নিদর্শন। শুরুতেই পাবেন মহারাজার দিঘি যা পঞ্চগড় সদর উপজেলার ভিতরগড়ে অবস্থিত। এখানে আছে শাল্মারা বিল আর সাথে আছে বন বিভাগের বিশাল শালবন। সেই সাথে মুঘল শাসক শাহ সুজার শাসনামলে নির্মান করা মির্জাপুর শাহী মসজিদ একটি অনন্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। তাছাড়া সংরক্ষিত প্রত্নতত্ত্ব বোদেশ্বরী মন্দির ঘুরে দেখতে পারেন বোদা উপজেলার বড়শশী ইউনিয়নে যেয়ে। জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার অপরূপ ছায়াঘেরা আর মন ছুঁয়ে যায় এমন একটি স্থান হল ময়নামতির চর। করতোয়া নদীর কোল ঘেঁষে প্রায় ৩৫ একর জমি জুরে বিস্তৃত এ বনাঞ্চল। পড়ন্ত বিকেলেসবুজে ঘেরা এ বনাঞ্চল হয়ে ওঠে আরও অপরূপ। পাশাপাশি যারা নৌকাভ্রমণ করতে চান তাদের জন্য রোমাঞ্চকর হতে পারে করতোয়ার বুকে ডিঙ্গি নৌকা ভ্রমণ