তিনদিন হলো। অফিসিয়ালি তাদের কী বলবো। নিখোঁজ? লাশ? কয়লা? হাড্ডি? রূপগঞ্জের হাশেম ফুডস কারাখানায় কাজ করতো তারা। ডেইলি স্টারের রিপোর্ট বলছে, তাদের অন্তত ১৬ জন ছিল শিশু। এমন দুর্ঘটনা এদেশে একেবারে অভিনব নয়। এটাকে কি দুর্ঘটনা বলা যায়। অবহেলাজনিত মৃত্যু? নাকি হত্যাকাণ্ড। জরুরি বের হওয়ার কোন সিঁড়ি ছিল না কারখানাটিতে।আগুন নেভানোর সিলিন্ডার বা যন্ত্রপাতি বা ফায়ার এলার্ম ছিল না কিছুই। সবচেয়ে বড় কথা প্রতিটি তলার দরজা ছিল তালাবদ্ধ। না হলে আরও শ্রমিক বের হতে পারতেন।
তাহলে এটি কি একটি মৃত্যুফাঁদ ছিল। সরকারি কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ এরইমধ্যে এ ঘটনায় মালিকপক্ষের সম্ভাব্য দোষীদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়? সরকারি কর্তৃপক্ষের যাদের এই কারাখানার কর্মপরিবেশ, অগ্নিনির্বাপণ এবং জরুরি বের হওয়া ব্যবস্থা, শিশু শ্রম দেখার কথা ছিল তারা কি সেটা দেখেছেন? এই অবহেলায় দায়ীদের কি আইনের আওতায় আনা হবে। কোনো পদক্ষেপ কি নেয়া হবে সব কারাখানার কর্মপরিবেশ নিশ্চিতে? মালিকরা কি দুঃখজনক এই অবস্থাতেও একবার ভাববেন, প্রতিটি শ্রমিকের জীবনও মূল্যবান। তাদেরও স্বাভাবিক জীবনের গ্যারান্টি প্রয়োজন। প্রয়োজন মর্যাদার সঙ্গে কাজ করার। সেদিন কি কখনও আসবে?
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির সময় এমন হয়েছিল। দম বন্ধ হয়ে আসছিল। এবারও ঠিক একই অনুভূতি। নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না। লিখতে গিয়েও লেখা যাচ্ছে না। কারও মনে থাকতে পারে। সেসময় নাম জানা একটি মেয়ের আটকে পড়া পায়ের ছবি প্রকাশ হয়েছিল। তা দেখে লিখেছিলাম, আপনি কি মেয়েটির ছবি দেখেছেন? তার মুখ দেখা যায় না। শরীরের অন্যকোন অংশও নয়। শুধু দেখা যায় একটি পা। যে পায়ে কঙ্কন বাঁধা। মেয়েটি কার দিকে তাক করে রেখেছে তার পা? আমার দিকে, আপনার দিকে? সভ্যতার মুখোশ সেলাই করতো ওরা। ওরা কেউ আমার মা, কেউ বাবা, কেউ ভাই কেউবা বোন। ওরা আটকে পড়েছে রানা প্লাজা নামে এক মৃত্যুপুরীতে। একদিন আগেও ওদের নাম ছিল। কারও নাম আসমা, কারও নাসিমা, কারও জয়নাল। এখন ওদের নতুন নাম হয়েছে ‘লাশ’। ক্ষমতাসীন দলের ক্ষমতাবান এক নেতা সোহেল রানা। সাভার বাসস্ট্যান্ডে তার ক্ষমতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল ৯তলা ভবনটি। পাঁচটি গার্মেন্ট আর একটি বেসরকারি ব্যাংক ছিল ওই ভবনে। মঙ্গলবার ভবনটিতে ফাটলের খবর পরদিন ছাপা হয়েছিল পত্রিকায়।
ভবনে থাকা বেসরকারি ব্যাংকটি বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ডলারের হিসাব আর বিশ্ব বাণিজ্যে যারা বড় বেশি প্রয়োজনীয় তাদের সেই সৌভাগ্য হয়নি। লোভী মালিকরা তাদের বাধ্য করেন কাজে যোগ দিতে। যে মেয়ে সকালে তার মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসেছিল, যে মা তার সন্তানকে রেখে এসেছিলেন বাসায় তারা কেউকি জানতেন এই তাদের শেষ দেখা। বুধবার সকালে মুহূর্তের মধ্যে ধসে পড়ে ভবনটি।
মানুষের আর্তনাদ আর বাঁচাও বাঁচাও আকুতিতে ভারি হয়ে ওঠে সাভারের বাতাস। উদ্ধার কাজে এগিয়ে আসেন হাজার হাজার মানুষ। চিকিৎসা দিতে এগিয়ে আসে হাসপাতাল। কিন্তু কত? একে একে বেরুতে থাকেন মানুষ। কেউ জীবিত। কেউবা নতুন নামে। বাইরে অপেক্ষা করতে থাকেন স্বজনেরা। একটিবারের মত স্বামীকে ফিরে পেতে চান স্ত্রী। বলছেন, প্রয়োজনে ভিক্ষা করে খাওয়াবেন স্বামীকে। মায়ের জন্য সন্তানের আহাজারি। মেয়েকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন বাবা? প্রিয় মানুষের ফোনটি একবার বেঁজে উঠুক এই তাদের প্রার্থনা। কেউ ছোটেন হাসপাতালে, কেউবা লাশের খোঁজে।
প্রিয়জনের লাশ পেলেও যেন কিছুটা সান্ত্বনা পাবেন তারা। আবারও কোন কোনও লাশও কি স্বজনের জন্য অপেক্ষা করছে না? মানুষ বসে আছেন মৃত্যুর অপেক্ষায় এরচেয়ে মর্মান্তিক দৃশ্য আর কি হতে পারে? টিভি চ্যানেলের লাইভ সম্প্রচারে এইসব দৃশ্য দেখে চোখের জল সামলাতে পেরেছেন খুব কম মানুষই। বিশ্ব মিডিয়ায় আবারও সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন আমাদের বস্ত্রবালিকারা। ওই লেখার শেষ দিকে ফের বলা হয় মেয়েটির কথা। এক পা উদ্ধত মেয়েটির কথা এ পর্যন্ত এসে আপনি নিশ্চয়ই ভুলে যাননি। তাকে নিয়েই অধ্যাপক আলী রীয়াজ লিখেছেন,
তোমার কঙ্কনের ধ্বনি বেজেছে মায়ের আঙ্গিনায়,
তোমার সংসারে
তোমার উর্ধ্বমুখী হাত উঠেছে প্রার্থনায়
সে গতকাল ছিলো
………….
………….
আগামীকাল তোমার কঙ্কনের ধ্বনি বাজবে না মায়ের আঙ্গিনায়, তোমার সংসারে
এখন তোমার পা উদ্ধত বাংলাদেশের দিকে।
ফিরে আসি রূপগঞ্জ ট্র্যাজেডিতে। আগেই বলেছি, এই ধরনের ঘটনা এদেশে অভিনব নয়। অফিসিয়ালি এখন পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা ৫২। কিন্তু অসহায় মানুষ তাদের প্রিয়জনের লাশটাও বুঝে পাচ্ছেন না। কারণ কারও চেহারাই চেনার উপায় নেই। অপেক্ষা করতে হবে ডিএনএ নমুনা পরীক্ষার ফলের জন্য।
নতুন এই পরিস্থিতিতে স্বজনরা হাজির হয়েছেন মর্মান্তিক এক দাবি নিয়ে। বাবা বলছেন, কন্যার হাড্ডিটাও যদি পাওয়া যেতো।