শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১:১২ পূর্বাহ্ন

এলাচের চাষ;বিদেশ থেকে এলাচ আমদানি করতে হবে না!

বিশেষ প্রতিনিধি / ৭৭৯ বার এই সংবাদটি পড়া হয়েছে
প্রকাশের সময় : বৃহস্পতিবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০২১

ওমর শরীফ তরুণ কৃষি উদ্যেক্তা ও বৃক্ষপ্রেমী এক যুবক। তার সংগ্রহে রয়েছে দেশী-বিদেশী অনেক ফুল, ফল ও ঔষধি গাছের চারা। চারা সংগ্রহ করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত ছাড়াও তিনি ছুটে চলেছেন থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, দুবাই ও পাশের দেশে ভারতে। স্বপ্ন তৈরি হলো একসময় দেশে গড়ে তুলবেন সব ধরনের দুর্লভ গাছের চারা। গড়ে তুলেছেন জোহরা অ্যাগ্রো ফার্মস অ্যান্ড নার্সারি নামে বিশাল পরিসর। রয়েছে ফলদ ও ঔষধি গাছের বাগান। কঠোর পরিশ্রম, একাগ্রতা, সততার ওপর ভর করে বুকভরা স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে অভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন শরীফ। তার দেখাদেখি উৎসাহ পেয়ে সহযোগিতা নিয়ে অনেক বেকার যুবক বাগান করছে। মিরসরাই উপজেলায় প্রথমবারের মতো এলাচের চাষ করেছেন তিনি। চট্টগ্রামে সবুজ রঙের ছোট এলাচের চাষ প্রথম শুরু করেছেন শরীফ।

সরেজমিন বাগানে গিয়ে দেখা গেছে, রোপণ করা এলাচ গাছে ফুল এসেছে। গোলাপি ধাচের একটা রঙ। কিন্তু চোখে পড়ল প্রতিটি ফুলের গোড়াতেই সবুজ রঙা একটা করে গুটি। এই গুটিগুলোই একেকটা এলাচদানা। আদা-হলুদ-সটিগাছের সাথে যাদের পরিচয় আছেÑ এই এলাচের গাছের সাথে তারা সাযুজ্য খুঁজে পাবেন। একই গোত্রের গাছ হয়তো; কিন্তু আদা কিংবা হলুদ যেমন গাছের নিচে শিকড়ে ধরে। এই গাছে এলাচ ধরে গাছের গোড়ার ভাগটায়। গোড়ার দিক থেকে লম্বাটে ধরনের একটি ফুল বের হয়। আর ফুলের গোড়ার দিকটাতেই বেড়ে ওঠে ফল। এই ফলই হচ্ছে আমাদের পরিচিত এলাচ। এমন একটি-দু’টি নয়; গাছের গোড়ায় মাটিসংলগ্ন হয়ে লতিয়ে ওঠা ডগাগুলোতে গুচ্ছ গুচ্ছ এলাচ ধরে। এখন গাঢ় সবুজ রঙ সেই এলাচের।কথা হয় তরুণ উদ্যোক্তা ওমর শরীফের সাথে। তিনি জানান, পাঁচ বছর আগে শখের বসে এলাচ চাষে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তবে আগ্রহী হলেই তো হবে না। উদ্যোগীও হতে হবে, যার কমতি নেই ওমর শরীফের। গুয়েতেমালা, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ভারত, ইরান ও ইন্দোনেশিয়া থেকে ২০০টি চারা সংগ্রহ করে আনেন। এরপর সেই চারা দিয়ে এলাচের এক মিশ্র বাগান করেন এই পাহাড়ি অঞ্চলে।

তবে পথটা অত সহজ ছিল না। চারা এনে লাগিয়ে দিলেই হয়ে যায় না, এর চাষের রীতিপদ্ধতিও রয়েছে। তা বুঝতে সময় লেগে যায়। এর বাইরে আছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ; কিন্তু হাল ছাড়েননি ওমর শরীফ। ব্রাউজ করে করে বিভিন্ন দেশের এলাচ চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে পড়াশোনা করে তার প্রয়োগ ঘটিয়ে তবেই এলাচ চাষ করে সফলতা পেয়েছেন তিনি।

কৃষি বিভাগ ও মসলা ইনস্টিটিউশনের কর্মকর্তারা একাধিকবার ওমর শরীফের বাগান পরিদর্শন করেছেন বলে জানান তিনি।
জানা গেছে, ওমর শরীফের বাগানে রয়েছে দেশী-বিদেশী প্রায় শতাধিক গাছ। রয়েছে বর্তমান বিশ্বের দামি মিয়াজাকি (সূর্যডিম) কিউজাই, ব্যানানা ম্যাংগো, ইন্দোনেশিয়ান ব্রুনাই কিং, কিং অফ চাকাপাত, আলফেনসো, আলফানচুন, থাই ব্যানানা আম গাছ।
এলাচগাছ ছাড়াও রয়েছে দারুচিনি, লবঙ্গ, এভাকাডো, পুলসান, রাম্বুটান, আপেল, তেঁতুল, থাই সবেদা, চেনাক ফ্রুট, থাই বেরিকেডেট মাল্টা, বারমাসী মাল্টা, চায়নিজ কমলা, দার্জিলিং কমলা, চায়না লিচু, লটকন, ভিয়েতনাম নারিকেল। অগামী কিছুদিন পর তিনি এভাকাডো, রাম্বুটান, পুলসান, ডুরিয়া, ম্যাগোইস্টানের চারারও সরহরাহ করার মনস্থির করেছেন।

এলাচ নিয়ে এখন অনেক জ্ঞান রাখেন ওমর শরীফ। জানালেন, দু’রকমের এলাচের ফলন হয়। বড় ও ছোট। বড় এলাচ এশিয়া, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের শীতপ্রধান অঞ্চলে প্রচুর জন্মায়। বড় এলাচের ৫০ প্রজাতির মধ্যে এ উপমহাদেশে বহু আগে থেকে বেশ কয়েকটির ফলন হয়। তবে চট্টগ্রামে এই সবুজ রঙের ছোট এলাচের চাষ ওমর শরীফই প্রথম শুরু করেছেন।

তিনি জানান, আষাঢ় মাসে ফুল আসে এলাচগাছে। আর ভাদ্র ও আশ্বিন মাসের শেষদিকে এলাচ পরিপক্ব হয়। তখন বাগান থেকে কাঁচা এলাচ সংগ্রহ করে রোদে শুকাতে হয়। বেশি উৎপাদন হলে ড্রায়ার মেশিনে শুকাতে হয়। না শুকিয়ে ঘরে রাখলে পচন ধরবে। ফল পরিপক্ব হলে দেখতে কিছুটা সবুজের উপর লালচে হবে। চারা লাগানো থেকে ফল পেতে তিন বছর অপেক্ষা করতে হয়।

বিভিন্ন জাতের এলাচের মধ্যে সবুজ-কালো, নীল-সাদা ও বেগুনিসহ ১৩ জাতের এলাচ আমদানি করা হয় বাংলাদেশে।
দেশে এলাচ চাষ নতুন নয়। সিলেট, বগুড়া, সাতক্ষীরা, তিন পার্বত্য জেলাসহ বেশ কয়েকটি অঞ্চলে এলাচ জন্মে। সেগুলোর নাম মোরঙ্গ এলাচ। কিন্তু সবুজ দানার এলাচ চাষ এটাই প্রথম। নিজের সাফল্যের পর কৃষকদের মাঝে এলাচের চাষ ছড়িয়ে দিতে জোহরা অ্যাগ্রো ফার্মস ও নার্সারিতে এখন চারা উৎপাদনেও মন দিয়েছেন ওমর শরীফ। যেখানে এবার প্রায় ১০ হাজার এলাচের চারা গজানো হবে।

বাণিজ্যিকভাবে এলাচ চাষে আগ্রহীরা এই বছর আমার কাছ থেকে চারা কিনতে পারবেন। চারা বড় হলে আগ্রহী চাষিদের কাছে বিক্রি করতে পারব। তাতে অদূর ভবিষ্যতে বিদেশ থেকে আর এলাচ আমদানি করতে হবে না, বলছিলেন এই কৃষি উদ্যোক্তা।তার স্বপ্ন সেখানেই থেমে নেই। বলছিলেন, ‘দেশের মাটিতে উৎপাদিত এলাচ নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে রফতানি করা হবে বিদেশেও। এতে সরকার পাবে বৈদেশিক মুদ্রা। আর সরকার যদি বাণিজ্যিকভাবে এলাচ চাষে আগ্রহীদের আর্থিক সহযোগিতা করে তাহলে খুব অল্প সময়েই এ স্বপ্নপূরণ সম্ভব।

ভারত, চীন ও মিয়ানমারসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের উর্বর জমি এলাচ চাষের উপযোগী। এলাচ চাষে আলাদা কোনো জমি প্রয়োজন হয় না।

ওমর শরীফ বলেন, পাঁচ বছরের পরিশ্রমে আমি দেখেছি, অন্য গাছের ছায়া তলে এলাচের ভালো ফলন হয়। তাই আমি মিশ্র ফলের বাগানে এলাচ চাষ শুরু করেছি। যে কেউ বাড়ির আঙিনা অথবা ফলদ বৃক্ষের বাগানে এ জাতের সবুজ সুঘ্রাণযুক্ত মসলা এলাচের চাষ করতে পারবে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ