ই-কমার্স ব্যবসার নামে প্রতারণা ঠেকাতে সরকার ডিজিটাল ই-কমার্স আইন প্রণয়ন ও রেগুলেটরি অথরিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। গত ২২ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র, আইন, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রীকে নিয়ে বৈঠক করে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ই-কমার্স আইন প্রণয়ন ও রেগুলেটরি অথরিটি গঠনের ঘোষণা দেন। সে মোতাবেক ১৬ সদস্যের কমিটিও গঠিত হয়। মন্ত্রণালয়ের এমন সিদ্ধান্তে গ্রাহক, মার্চেন্ট, সুশীল সমাজের মধ্যে এক ধরনের আশার সঞ্চার হয়। কিন্তু গতকাল মঙ্গলবার ডিজিটাল কমার্স আইন এবং শক্তিশালী কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠায় গঠিত কমিটির প্রথম বৈঠকেই নতুন আইন না বিদ্যমান আইনে ই-কমার্স ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ (ব্যবস্থাপনা) করা হবে তা ঠিক করতে একটি উপকমিটি গঠন করা হয়েছে।
কমিটির এমন সিদ্ধান্তে ই-কমার্সের অংশীজনরা মনে করছেন সরকার কি তা হলে ই-কমার্স আইন প্রণয়ন ও রেগুলেটরি অথরিটি গঠন থেকে সরে আসছে? তারা এও জানিয়েছেন, দেশে প্রায় ৩০ হাজার ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর সঙ্গে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে ২ লক্ষাধিক মানুষের। আর ৮০ লাখ পরিবার এর ভোক্তা। এ জন্য এ উদীয়মান ই-কমার্স খাতকে বিশ্বমানে রূপ দিতে এবং এ মাধ্যমে প্রতারণা ও জালিয়াতি ঠেকাতে একটি শক্তিশালী আইন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গঠন প্রয়োজন।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন ই-কমার্সের নামে পণ্য আমদানি বা ডেলিভারি দেওয়ার মাধ্যমে ওভার কিংবা আন্ডার ইনভয়েস করে দেশের
অর্থ কেউ যেন পাচার করতে না পারে বা মানিলন্ডারিংয়ের মতো কোনো অপরাধ করতে না পারে সে সুরক্ষায় নতুন আইন প্রণয়ন দরকার।
দুর্নীতি দমন কশিনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান ও কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) প্রেসিডেন্ট গোলাম রহমান আমাদের সময়কে বলেন, ই-কমার্স খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে নতুন আইন এবং রেগুলেটরি অথরিটি বা কমিশন গঠন করা যৌক্তিক। এ ছাড়া বিদ্যমান আইনে যে ধরনের শাস্তির বিধান আছে তা বাড়ানো দরকার।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সাবেক চেয়ারম্যান ও ট্রাস্টি এম হাফিজ উদ্দিন খান আমাদের সময়কে বলেন, এ বিষয়ে আইন প্রণয়ন একটি সময়পোযোগী পদক্ষেপ। ই-কমার্স একটি উদিয়মান খাত। কয়েকটি কোম্পানির জন্য এ খাত বিকাশে প্রতিবন্ধকতা তৈরি না করে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার পক্ষে মত দেন তিনি।
গতকাল মঙ্গলবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ডিজিটাল কমার্স আইন প্রণয়ন ও কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা কমিটির সভা শেষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, ই-কমার্সের জন্য নতুন আইন হবে কিনা বা ই-কমার্স কর্তৃপক্ষ গঠিত হবে কি না, সেটা জানা যাবে আরও এক মাস পর। আইন ও কর্তৃপক্ষ গঠনের বিষয়ে একটি সাব-কমিটি হয়েছে। সে সাব-কিমিটির রিপোর্টের ওপর নির্ভর করবে নতুন আইন ও কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে কিনা। কমিটি পুরো বিষয়টি পর্যালোচনা করবে।
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন আছে, প্রতিযোগিতা কমিশন আইন আছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আছে, এমনও হতে পারে বর্তমান আইনগুলোকে সংশোধন করে নতুন কোনো ধারা, উপধারা সংযোজন হবে। আর কর্তৃপক্ষ করতে বেশ সময় লাগে, এখানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের জড়িত থাকার বিষয় আছে। সহসা কর্তৃপক্ষ গঠন সম্ভব না-ও হতে পারে। তবে আমরা ডিজিটাল কমার্স সেলকে শক্তিশালী করব। এ সেলকে কারিগরিভাবেও সহায়তা দেওয়া হবে।’
তিনি বলেন, ই-কমার্স কর্তৃপক্ষ করতে বেশ সময় লাগে, এখানে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের জড়িত থাকার বিষয় আছে। হঠাৎ যদি ছয় মাসের মধ্যে ডিজিটাল কর্তৃপক্ষ করতে বলা হয়Ñ সে ক্ষেত্রে অফিস ও অভিজ্ঞতাসহ সার্বিক বিষয়গুলো দ্রুত করা সম্ভব নাও হতে পারে। তবে ডিজিটাল কমার্স সেলকে আমরা শক্তিশালী করব। এ সেলকে কারিগরি সহায়তাও দেব। আমাদের ভাবনা সাব-কমিটিকে জানানো হয়েছে।
সফিকুজ্জামান বলেন, সাব-কমিটিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নের্তৃত্বে বাংলাদেশ ব্যাংক থাকবে, ভোক্তা অধিকারের প্রতিনিধি, কম্পিটিশন কমিশনের প্রতিনিধি, লেজিসলেটিভ ডিভিশনের প্রতিনিধি, এটুআই প্রতিনিধি, এফবিসিসিআই প্রতিনিধি, ই-ক্যাব ও বেসিসের প্রতিনিধি থাকবে।
ই-কমার্সে বর্তমান দুরবস্থা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যে ক্ষতি হয়ে গেছে, হয়ে গেছে। এটা আমরা ফিরিয়ে আনতে পারব না।
এক প্রশ্নের জবাবে অতিরিক্ত সচিব বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি ডিজিটাল সেল আছে। সেলটি একটি এসওপি করেছে। সেটা একটা গাইডলাইন। ফলে সেখানে আইন প্রয়োগের সুযোগ কম। এসওপি প্রয়োগের জন্য যে লিগ্যাল অথরিটি সেটা থাকে না। তাই ডিজিটাল কমার্সকে শক্তিশালী করতে সাব-কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে দ্রুত সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। পুরো বিষয়টির নিয়ন্ত্রণ নয়, মনিটরিং করা হবে।
এর আগে গত ২৮ সেপ্টেম্বর ই-কমার্স আইন ও কর্তৃপক্ষ গঠনের লক্ষ্যে ১৬ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। এতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আমদানি ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য) এএইচএম সফিকুজ্জামানকে কমিটির আহ্বায়ক এবং উপসচিব (কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেল) মুহাম্মদ সাঈদ আলীকে সদস্যসচিব করা হয়।আলিশা মার্ট বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অমান্য করছে, এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি নাÑ জানতে চাইলে সফিকুজ্জামান বলেন, আমাদের গত ২২ সেপ্টেম্বর যে মিটিং হয়েছিল সেখানে পাঁচ নম্বর সিদ্ধান্ত ছিল, ডিজিটাল কমার্সের সব বিজ্ঞাপনে সতর্কীকরণ ট্যাগ যুক্ত করতে হবে। ই-ক্যাবের পক্ষ থেকে জেনেছি, এরই মধ্যে বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। আমরা ফুলটাইম এটা নিয়ে কাজ করছি। আমার অফিসারকে দায়িত্ব দিয়েছি, কী বিজ্ঞাপন যাচ্ছে তা দেখে রিপোর্ট দিতে। পরে আমরা রিভিউ করব।
ই-কমার্স বিষয়ে তিনি বলেন, যেগুলো ভালো কোম্পানি সৎভাবে ব্যবসা করছে, আমরা তাদের সুযোগ দিতে চাই। তাদের ব্যবসা বন্ধ করতে চাই না। তবে আমরা এখন নিয়ন্ত্রণ করার চিন্তা করছি। তাদের আমরা স্পেস দিয়েছি। ই-কমার্সে ভালো অনেক কোম্পানিও রয়েছে, যেখানে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে, করোনাকালীন বিশালসংখ্যক মানুষ কাজের সুযোগ হয়েছে। বাংলাদেশ ই-কমার্সকে লিড দেবে, আমরা সে লক্ষ্যেই কাজ করছি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দুই বছর আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করলে ই-কমার্স খাতের বর্তমান দুরবস্থা হতো না এবং এ জন্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ই দায়ী। এ বিষয়ক প্রশ্নের জবাবে সফিকুজ্জামান বলেন, ‘যে ক্ষতি হয়ে গেছে, হয়ে গেছে। এটা আমরা ফিরিয়ে আনতে পারব না। সুনির্দিষ্টভাবে এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার এখতিয়ার আমার নেই।’