শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১:১৩ পূর্বাহ্ন

আত্নজয় ও আমাদের কোরবানী

বেদুইন হায়দার লিও / ৩৮৯ বার এই সংবাদটি পড়া হয়েছে
প্রকাশের সময় : মঙ্গলবার, ১২ জুলাই, ২০২২

আত্নজয় ও আমাদের কোরবানী

লেখক বেদুইন হায়দার লিও-

সকলকে পবিত্র ঈদুল আজহার শুভেচ্ছা। একটা টেলিভিশন বিজ্ঞাপনের গিঙ্গেল ছিল এমন ” এক বছরে দুই আর খুশি আমরা মুসলমান একটা হল রমজানের ইদ আর একটা কোরবান। মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম আনান্দ উৎসব।
কোরবানি কি? এটা বললে আল্প কথায় এমন
আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা লাভের উদ্দেশ্যে কিছু বিসর্জন দেয়াকে কোরবানি বলা হয়। আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান (ছাহেবে নিসাব) ব্যক্তির উপর কোরবানির হুকুম পালন ওয়াজিব। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কেউ যদি কোরবানির মতো ইবাদত থেকে বিরত থাকে, তাহলে সে ব্যক্তি গুনাহগার হবেন।

কিন্ত এখন কালের পরিক্রমায় আমরা উৎসব টি ঠিক রেখে যে ত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিত ঈদুল আজহা তার আর্দশের থেকে কিছুটা দুরে সরে যাচ্ছি। প্রসংগত আমরা কোরবানির ইতিহাসের দিকে যায় বিষয়গুলো সকলের জানা তাই সংক্ষিপ্ত করে উল্লেখ করছি।
আদি পিতা আদম (আঃ)-এর দুই পুত্র কাবীল ও হাবীলের দেওয়া কুরবানী থেকেই কুরবানীর ইতিহাসের গোড়াপত্তন হয়েছে।
পৃথিবীর প্রথম মানব হযরত আদম (আ:)-এর সন্তান হাবিল ও কাবিলের মধ্যে বিয়ে নিয়ে মতভেদ দেখা দিল। আদম (আ.) তার এ দুই সন্তান হাবীল ও কাবীলের মতভেদ দূর করার উদ্দেশ্যে বললেন: ‘তোমরা উভয়ে আল্লাহর উদ্দেশ্যে কুরবানী পেশ কর। যার কুরবানী গৃহীত হবে, তার সাথেই আকলিমার বিয়ে দেয়া হবে।’
সে সময় কুরবানী গৃহীত হওয়ার একটা সুস্পষ্ট নিদর্শন ছিল যে, আকাশ থেকে একটি অগ্নিশিখা এসে সে কুরবানীকে জ্বালিয়ে দিত। আর যার কুরবানী কবুল হতো না তার টা সেখানেই পড়ে থাকত।
তখনকার কুরবানীর পদ্ধতি সম্পর্কে জনা যায়, কাবিল ছিলেন চাষী। তিনি গমের শীষ থেকে ভাল ভালগুলো বের করে নিয়ে খারাপ গুলোর একটি আটি কুরবানীর জন্য পেশ করলেন। আর হাবিল ছিলেন পশুপালনকারী। তিনি তার জন্তুর মধ্যে থেকে সবচেয়ে ভাল একটি দুম্বা কুরবানীর জন্য পেশ করেন। এরপর নিয়মানুযায়ী আকাশ থেকে অগ্নিশিখা এসে হাবিলের কুরবানীটি ভষ্মীভূত করে দিল। আর কাবিলের কুরবানী যথাস্থানেই পড়ে থাকল। (সংক্ষেপ; তাফসীর ইবনু কাসীর, দুররে মনসূর, ফতহুল বায়ান, ৩/৪৫ ও ফতহুল ক্বাদীর, ২/২৮-২৯)
তারপর থেকে বিগত সকল উম্মতের উপর এটা জারী ছিল। আমাদের উপর যে কুরবানীর নিয়ম নির্ধারিত হয়েছে, তা মূলতঃ ইবরাহীম (আঃ) কর্তৃক শিশু পুত্র ইসমাঈল (আঃ)- কে আল্লাহর রাহে কুরবানী দেওয়ার অনুসরণে ‘সুন্নাতে ইবরাহীমী’ হিসাবে চালু হয়েছে।
মক্কা নগরীর জনমানবহীন ‘মিনা’ প্রান্তরে আল্লাহর দুই আত্মনিবেদিত বান্দা ইবরাহীম ও ইসমাঈল আল্লাহর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মাধ্যমে তুলনাহীন ত্যাগের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, বর্ষপরম্পরায় তারই স্মৃতিচারণ হচ্ছে ‘ঈদুল আযহা’ বা কুরবানীর ঈদ।
আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণের প্রকৃষ্ট নমুনা এই কুরবানীতে প্রতীয়মান। তাই কুরবানী বলা হয় ঈদুল আজহার দিনগুলোতে নির্দিষ্ট প্রকারের গৃহপালিত পশু আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য জবেহ করা। ইসলামি শরিয়তে এটি এবাদত হিসেবে সিদ্ধ, যা কুরআন, হাদীস ও মুসলিম উম্মাহর ঐক্যমত দ্বারা প্রমাণিত।
কুরআন মজীদে যেমন এসেছে –
‘তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর ও পশু কুরবানী কর।’
সুরায়ে কাউসারে আল্লাহ তায়ালা হুজুর সা. কে হুকুম করে বলেন-
নিশ্চয় আমি আপনাকে হাউজে কাউসার দান করেছি। অতএব আপনার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে নামাজ ও কুরবানি আদায় করুন।
আল্লাহ তাআলা অন্য আয়াতে বলেন- হে আমার হাবিব আপনি বলুন যে, অবশ্যই আমার নামাজ, আমার কুরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ, সব কিছুই মহান প্রতিপালকের জন্য। (সূরা আনআ’ম- ১৬২)
আল্লাহ তাআলা আরো বলেন- তারা কতক নির্দিষ্ট দিনে গৃহ পালিত চতুষ্পদ জন্তুর মাধ্যমে আল্লাহকে স্মরণ করে। (সুরা হজ্ব: আয়াত- ২৮)
কুরবানির আত্মত্যাগের এ পরীক্ষায় সফলকাম হয়েছিলেন মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালাম। আর তিনি ‘খলিলুল্লাহ’ বা আল্লাহর প্রিয়বন্ধু উপাধি লাভ করেছিলেন।
কোরবানির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস থেকে এর গুরুত্ব গুলো বুঝতে পারলাম। মহান আল্লাহতালার নৈকট্য আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিৎ কিন্তু আমরা তা না করে হয়তো মাংস উৎসব করছি। যদিও সবাই তা করছে না কিন্তু সচেতন মাত্রই সমাজ কে অগ্রিম বার্তা দেওয়া উচিৎ আমরা অবক্ষয়ের দ্বার প্রান্তে চলে এসেছি। কোরবানি আসল কাজটি তাকওয়া থেকে আমরা ক্রমশ দুরে সরে যাচ্ছি হয়তো। মহাগ্রন্থ আল- কুরআনের দুটি সুরার দুটি আয়াত এমন
আল্লাহর কাছে (কুরবানীর পশুর)) গোশত ও রক্ত পৌঁছে না বরং তোমাদের অন্তরের তাকওয়া পৌঁছে থাকে। (সূরা হজ্ব, আয়াত- ৩৭)
আত্মত্যাগ যেন হয় শুধু আল্লাহর জন্য। আল্লাহ তায়ালা বলেন নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার কুরবানি, আমার জীবন এবং আমার মৃত্যু সব কিছু সমগ্র জগতের মালিক আল্লাহর তায়ালার জন্য। (সূরা আন-আম আয়াত-১৬২ )
এই সুরার আয়াতের আলোকে বলা যাশ
কুরবানি হচ্ছে আত্ম কুরবানির প্রতীক। কুরবানির পশু জবাই আসলেই প্রতীকী ব্যাপার। আল্লাহ তাআলা নিজেই বলেছেন, পশুর গোশত, চামড়া, রক্ত কিছুই তার কাছে পৌঁছায় না। পৌঁছায় শুধু বান্দার তাকওয়া ও পরহেজগারি।শুধু পশু নয়, পশুত্বের কুরবানি দিতে হয়।

প্রতিটি মানুষের ভিতর নফসে আম্মারা নামক একটি হিংস্র পশু আছে ,যা প্রতিনিয়ত মানুষকে অন্যায় ও পাপ কাজে প্ররোচিত করে থাকে এবং আত্মাকে পাপিষ্ঠ আত্মায় পরিণত করে। পশুত্ব হলো অপরিচ্ছন্ন শত কালিমাময় আত্মা অর্থাৎ পাপিষ্ঠ আত্মা। মানুষের অন্তরাত্মা পাপে ভরা, যেটার সম্মিলিত নামই পশুত্ব। সর্বপ্রথম এই পাপিষ্ঠ আত্মা অর্থাৎ পশুত্বকে কুরবানি করার পর পশু কুরবানি করা উচিৎ। এই বিষয়টির সাথে রিপুর তুলনা করতে পারি।( মানুষের ছটি শত্রু, ষড়রিপু। ষড় অর্থাৎ ছয়, রিপু অর্থাৎ সহজাত দোষ।

(১)কাম (lust) – লালসা(২)ক্রোধ (anger) – রাগ,(৩)লোভ (greed) – লোলুপতা, লিপ্সা,(৪) মদ (arrogance/vanity) – অহংকার, দর্প (৫)মোহ (attachment) – আসক্তি, টান (৬) মাৎসর্য (envy/ মহান ইসলামি আদর্শ হিসাবে অসূয়া, পরশ্রীকাতরতা) এই রিপু এগুলো প্রতিটি মানুষের জন্মগত। আমাদের চেষ্টা করা উচিত এগুলো বাড়তে না দেয়া বা নিয়ন্ত্রণে রাখা।এটাই হতে পারে মানুষের সর্বোত্তম কোরবানি।

এভাবে এই শিক্ষা আমরা আমাদের দেশের সকল মুসলিম পরিবারের মধ্যে ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধ এবং মহান ইসলামি আদর্শ হিসাবে স্মরণ করিয়ে দিতে পারি। মুসলিম জাতিকে এ মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ হওয়ার জন্যই হজ ও কুরবানির অনুষ্ঠান।

কিন্তু দূঃখের বিষয়, বর্তমানে বিজাতীয় অপসংস্কৃতি এবং চিন্তাধারার অনুপ্রবেশ আমাদের ধর্মীয় ও শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ হিসাবেও মানবিক মূল্যবোধের উপর চরম আঘাত হেনেছে। কুরবানি শুধুমাত্র একটি নিছক আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে। লোক দেখানো পশু কেনা, পশু কিনতে গিয়ে প্রতিযোগিতা ও আড়ম্বড়তার বহিঃপ্রকাশ লক্ষ্য করা যাচ্ছে প্রতিনিয়ত । অথচ কুরবানি করার বিধান এ জন্য হয়নি। লোক দেখানো ইবাদত নিশ্চয়ই আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়ার নয়।মহান আল্লাহতালা তার প্রিয়নবী মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম এর উম্মতদের নিশ্চয়ই এমন শিক্ষা দেন নাই ।

মহান স্রষ্টার প্রতি যথার্থ আনুগত্য প্রদর্শন, তাঁর সন্তুষ্টি ও মানব কল্যাণে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করার জন্য ধর্মীয় অঙ্গীকার ঘোষণায় সামাজিক আনন্দের উৎসব হিসেবে ঈদুল আজহা উদযাপিত হয় বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্বে।
এ উৎসব আত্ম-বিশ্লেষণ ও আত্মশুদ্ধিসহ পশুত্ব কুরবানির উৎসব। তাই আমাদের ত্যাগের মানসিকতা তৈরি করতে হবে। মনুষ্যত্ব ও মানবতাবোধকে জাগ্রত করতে হবে। যথাযথভাবে কুরবানি করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য ও বান্দার ভালোবাসা অর্জন করতে হবে। তবেই কুরবানি পালনের যথার্থতা উপলব্ধি করা সম্ভবপর হয়ে উঠবে।মনের পশুত্ব কে কোরবানি করে আত্নজয়ের চেষ্টা ও তার আর্জনের মাধ্যমেই হতে পারে আসল কোরবানী।

আপনার করা পশু কোরবানি দিতে পারে আপনার আসেপাসের সকল মেহনতী হত দরিদ্র মানুষের এক আনন্দ কারণ তারা সমাজের বঞ্চিত, নিপিড়ীত অধিকার হারা সাধারণ জনগণ আপনার প্রতিবেশী। মহান আল্লাহ আপনাকে সার্মথ্য দিয়েছেন এটারই পরীক্ষার জন্য। আর মানুষের পশুত্ব না থাকলেই তো প্রকৃত সাম্য ও ইসলামিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে । আল্লাহ তাআলা আমাদের কুরবানির ত্যাগ ও উৎসর্গকে কবুল করুন। সবাই কে কোরবানির আসল মহত্ত্ব বোঝার তৌফিক দান করুন। আমিন।

  • লেখক… 
  • বেদুইন হায়দার লিও


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ