সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১২:৩৪ পূর্বাহ্ন

সিগারেটে রাজস্ব ক্ষতি ৩৫০০ কোটি টাকা

অনলাইন ডেস্ক / ১১৭ বার এই সংবাদটি পড়া হয়েছে
প্রকাশের সময় : রবিবার, ১৪ মে, ২০২৩
Piles of euro coins with red decreasing arrow - Loss of money concept

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ঢিলামি ও ভুল নীতির কারণে সরকার ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব হারিয়েছে।এনবিআর-এর বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে বাড়তি দরে সিগারেট বিক্রি করায় এ রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে। এতে ভোক্তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আর সরকার বঞ্চিত হয়েছে প্রাপ্য রাজস্ব থেকে।

এই প্রেক্ষাপটে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাজেটের খসড়া চূড়ান্ত করতে রেওয়াজ অনুযায়ী আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনায় বসতে যাচ্ছে এনবিআর-এর প্রতিনিধিদল। বৈঠকে সিগারেটের বিক্রয়মূল্য, ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা নির্ধারণসহ জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন প্রধানমন্ত্রী।

সূত্র জানায়, গত অর্থবছরে সিগারেট খাতে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা ভ্যাট আদায় হয়েছে, যা মোট আদায়কৃত ভ্যাটের প্রায় ৩০ শতাংশ। রাজস্ব আদায়ের সবচেয়ে বড় একক খাত হওয়ায় আগামী বাজেটে সিগারেট খাতে এনবিআর-এর বিশেষ নজর থাকবে।

এ খাতে রাজস্ব পরিহার রোধে আইনি কঠোর পদক্ষেপ থাকবে। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী সিগারেটের বিক্রয়মূল্য, করমুক্ত আয়ের সীমা, সারচার্জ বা সম্পদ করের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ ও রাজস্ব নীতিসংশ্লিষ্ট বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেবেন। মূলত এ বৈঠকে বাজেটে রাজস্ব নীতি চূড়ান্ত হবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, সিগারেটের মূল্য নির্ধারণেই গোঁজামিল আছে।

বর্তমান সময়ে খুচরা পয়সার প্রচলন বা বিনিময় মূল্য না থাকা সত্ত্বেও প্রতি শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য নির্ধারণে ভাঙতি পয়সা রাখা হয়। এ কারণে খুচরা পর্যায়ে বিক্রির সময় পূর্ণাঙ্গ টাকায় মূল্য রাখা হয়। যেমন ১৪ টাকা ২০ পয়সার বেনসন বা মালবোরো সিগারেট ১৫-১৬ টাকা বিক্রি হচ্ছে।

বর্ধিত এ অর্থ থেকে এনবিআর অতীতে কখনো রাজস্ব আদায় করতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না। তাই ভবিষ্যতে মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।

তিনি আরও বলেন, বর্ধিত দামে সিগারেট বিক্রির বিষয়টি নজরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই এনবিআর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আদায় করতে পারত।

প্রতিবছর বাজেটে এনবিআর সিগারেটের বিক্রয়মূল্য, সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাট নির্ধারণ করে দেয়। যেমন, চলতি বাজেটে অতি উচ্চস্তরের (বেনসন, মালবোরো) ১০ শলাকা সিগারেটের মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে ১৪২ টাকা।

একইভাবে উচ্চস্তরের (গোল্ডলিফ) ১০ শলাকার মূল্য ১১১, মধ্যম স্তরের (স্টার, নেভি) ১০ শলাকার মূল্য ৬৫ এবং নিম্নস্তরের (হলিউড, ডার্বি) ১০ শলাকার মূল্য ৪০ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। অতীতে এই মূল্যেই খুচরা পর্যায়ে সিগারেট বিক্রি হলেও গত কয়েক বছর ধরে খুচরা বিক্রেতারা বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে বেশি মূল্যে বিক্রি করছেন।

পাশাপাশি অতি উচ্চস্তর, উচ্চস্তর, মধ্যম স্তরের সিগারেট উৎপাদনে সম্পূরক শুল্ক ৬৫ শতাংশ এবং নিম্নস্তরের সিগারেটে ৫৭ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে ১৫ শতাংশ মূসক বা ভ্যাট রয়েছে। সব মিলিয়ে অতি উচ্চস্তর, উচ্চস্তর, মধ্যম স্তরের সিগারেটে শলাকাপ্রতি ৮০ শতাংশ এবং নিম্নস্তরের সিগারেটে ৭২ শতাংশ রাজস্ব আরোপিত আছে।

হিসাব মতে, এক শলাকা বেনসন ও মালবোরো বিক্রি হওয়ার কথা ১৪ টাকা ২০ পয়সা দরে; কিন্তু বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৫-১৬ টাকা দরে। একইভাবে ১১ টাকা ১০ পয়সার গোল্ডলিফ ১২ টাকায়, ৬ টাকা ৫০ পয়সার স্টার ও নেভি ৭ টাকা এবং ৪ টাকার ডার্বি, হলিউড ও শেখ বিক্রি হচ্ছে ৫ টাকায়।

খুচরা পর্যায়ে বাড়তি দামে সিগারেট বিক্রি করায় প্রতি শলাকায় (৮০ পয়সা/১.৮০ টাকা* ৮০ শতাংশ) অতি উচ্চস্তরের সিগারেটে ৬৫ পয়সা থেকে ১ টাকা ৪৪ পয়সা, উচ্চস্তরে ৭২ পয়সা, মধ্যমস্তরে ৪০ পয়সা এবং নিম্নস্তরের সিগারেটে (১ টাকা* ৭২ শতাংশ) ৭২ পয়সা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।

এই বিপুল অঙ্কের রাজস্ব ক্ষতির বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরে গত বছরের আগস্টে বৃহৎ করদাতা ইউনিটের (এলটিইউ-ভ্যাট) তৎকালীন কমিশনার ওয়াহিদা রহমান চৌধুরী এনবিআর-এ চিঠি দেন এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সঙ্গে সভা করেন। সেপ্টেম্বরে বৈঠকের কার্যবিবরণীতে আইনগত বাধ্যবাধকতা তুলে ধরে তা সমাধানে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানান। কিন্তু এনবিআর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।

গত মার্চ পর্যন্ত সিগারেট উৎপাদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দেশের সর্ববৃহৎ সিগারেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো অতি উচ্চস্তরের (বেনসন) ৪৩৬ কোটি ৬২ লাখ শলাকা, উচ্চস্তরের (গোল্ডলিফ) ২৫৪ কোটি ৮১ লাখ শলাকা, লাকি স্ট্রাইক ৬৩ কোটি ৫৫ লাখ শলাকা, মধ্যম স্তরের স্টার ৪২৫ কোটি ৩৯ কোটি শলাকা এবং নিম্নস্তরের হলিউল/ডার্বি ৩ হাজার ৮৭ কোটি শলাকা সিগারেট বিক্রি করে। এসব সিগারেট বর্ধিত দামে বিক্রি করায় রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে স্তরভিত্তিক যথাক্রমে ২৭৯ কোটি থেকে ৬২৮ কোটি, ১৮৩ কোটি, ৯১ কোটি, ১৭০ কোটি এবং ২ হাজার ২২৩ কোটি টাকা।

একইভাবে ইউনাইটেড ঢাকা টোব্যাকো মধ্যম স্তরের ক্যামেল সিগারেট ১২ কোটি ৯১ শলাকা, নেভি সিগারেট ১৩৭ কোটি ৭৫ লাখ শলাকা এবং নিম্নস্তরের সেখ সিগারেট ১৩১ কোটি শলাকা বিক্রি করে। এতে রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে যথাক্রমে ১৫ কোটি ৫০ লাখ, ৫৫ কোটি ১০ লাখ এবং ৯৪ কোটি টাকা। অতি উচ্চস্তরের আরেকটি জনপ্রিয় ব্র্যান্ড মালবোরোর উৎপাদনের তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, এ ব্র্যান্ডের সিগারেট থেকেও সরকার মোটা অঙ্কের রাজস্ব হারিয়েছে।

সব মিলিয়ে খুচরা পর্যায়ে বাড়তি দামে সিগারেট বিক্রি হওয়ায় ৯ মাসে সরকার সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব হারিয়েছে। মালবোরো ব্র্যান্ডের সিগারেটের তথ্য যোগ করলে রাজস্বহানির পরিমাণ ৪ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে।

এ বিষয়ে তামাকবিরোধী সংস্থা আর্ক ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. রুমানা হক যুগান্তরকে বলেন, আমাদের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বেশি দামে সিগারেট বিক্রি করায় অর্থবছর শেষে সরকারের প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব ক্ষতি হবে। গবেষণালব্ধ ফলাফল তুলে ধরে এনবিআরকে চিঠিও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এনবিআর বিষয়টি আমলে নেয়নি।

তিনি আরও বলেন, বেশি দামে সিগারেট বিক্রির পেছনে প্যাকেটের গায়ে লেখা ‘খুচরা মূল্য’ ও ‘সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য’ শব্দ দুটিকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করছে তামাক কোম্পানিগুলো। এক্ষেত্রে প্রজ্ঞাপন বা বিধিমালায় জটিলতা যদি থেকেও থাকে, এনবিআর-এর উচিত ছিল বিষয়টি দ্রুত সমাধান করা। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে এনবিআর পদক্ষেপ না নেওয়ায় সরকার মোটা অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে। আগামী দিনে বাজার মনিটরিং জোরদারের পাশাপাশি বাজেটে এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া উচিত।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ