ঝিনাইদহ সদর উপজেলার ১৭ টা ইউনিয়নে ২০২২ ও ২০২৩ অর্থবছরে ৩০০ জন কৃষকের মধ্যে গ্রীষ্মকাল পেঁয়াজ চাষের জন্য কৃষক প্রতি ২৮ শত নগদ টাকা, ৪০ কেজি ইউরিয়া ফসফরাস জাতীয় সার ও এক কেজি উন্নত জাতের পেঁয়াজের বীজ ১ রোল পলিথিন ও কৃষকের প্রশিক্ষণ বাবদ ৭৫০ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। তবে এই প্রকল্পে ঝিনাইদহ সদর উপজেলার কৃষি বিভাগের ব্যাপক অনিয়ম, স্বজন প্রীতি ,কৃষক নির্বাচনে অবহেলা , যন্ত্রতন্ত্রভাবে যে কোন একজনকে কৃষক সাজিয়ে বীজ বিতরণ সহ যথাযথ উপযুক্ত সময় বীজ কৃষকের হাতে পৌঁছে না দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
এই অনিয়মের ফলে সরকার কৃষকের জন্য ব্যাপক ব্যয় করলেও কৃষি বিভাগের চরম অবহেলা ও উদাসীনতার কারণে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পেঁয়াজ উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না । জানা গেছে যে সরকারের এই প্রকল্পে বরাদ্দকৃত অর্থ প্রায় ৪০ লক্ষ টাকা। বরাদ্দকৃত ব্যাপক এই অর্থ দেশের কোন কাজেই আসেনি। ঝিনাইদহ সদর উপজেলার কৃষি বিভাগের এই অনিয়ম এর খবর সাংবাদিকরা জানতে পারার পর ঝিনাইদহ সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ জাহিদুল করিম এর নিকট কৃষক এর তালিকা জানতে চাহিলে সে তালিকা প্রদান না করার জন্য বিভিন্ন তালবাহানা করে।
১০ই ডিসেম্বর তার কাছে কৃষকের তালিকা চাইলে সে বলে যে বিধি মোতাবেক আবেদন করেন। ১৮ ডিসেম্বর বিধি মোতাবেক আবেদন করে ইমেলে সে তালিকা দিতে দেরি করার জন্য বলেন যে ২০ কর্ম দিবস এর মধ্যে আমি আপনাকে তালিকা দেব। অর্থাৎ এই সময়ের ভিতরে মাঠে গেলে কোথাও যাতে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের খেত না পাওয়া যায়। তারপর ৮ই জানুয়ারি সে ইমেইলে সাংবাদিক কে মেল পাঠিয়ে তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ এর ৯ ধারা এর ( ৬ ও ৭ উপধারা মোতাবেক ধারা ) মোতাবেক ইলেকট্রনিক ফরম্যাট বাবদ ৪০০ কৃষকের তালিকা প্রদানের জন্য ৪০০ টাকা খরচ দাবি করেন। অথচ ওই ধারায় তথ্য প্রদানের মূল্য স্বরূপ ফটোকপি প্রতি কপি ২ টাকা করে নেয়ার কথা আছে। ইমেইল করলে তথ্য অধিকার আইন অনুযায়ী বিনা খরচে তথ্য প্রদানের নিয়ম আছে। তখন সাংবাদিক এই তথ্য নেয়ার জন্য ১৫ ই জানুয়ারি সোনালী ব্যাংকে ৪ ০০ টাকা ফি জমা দিয়ে এই তথ্য সংগ্রহ করে।
কৃষকের তালিকা পাওয়ার পর মাঠ পর্যায়ে সরজমিনে ব্যাপক অনিয়মের তথ্য পাওয়া যায়। ঝিনাইদহ সদর উপজেলার সাধুহাটি ইউনিয়নের সাধুহাটি গ্রামে ১১ জন কৃষকের গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের প্রণোদনা সরবরাহ করা হয়েছে। তবে কোন পেঁয়াজের ক্ষেত পাওয়া যায়নি। শাহীন নামের একজন কৃষক দাবি করে যে সে এই জমিতে পেঁয়াজ করেছিল তবে বর্তমানে সেই জমিতে ভুট্টো চাষ হয়েছে। সুমন নামের একজন কৃষকের খেতে দেখা যায় যে রসুনের চাষ হয়েছে। সুমন দাবি করেছে এই খেতে পেঁয়াজ করার পর সে রসুন চাষ করেছে। রাশিদুল নামে একজনের দুই তিন কাটা জমিতে দেখা যায় যে খুব হালকা ভাবে ছোট ছোট পেঁয়াজের চারা হয়েছে। সুমনের খেতে কৃষি বিভাগের রসুনের প্রদর্শিত খামারের রসুন বপনের তারিখ ৭/-১১ /২০২২। পেঁয়াজের বীজ বিতরণের তারিখ দেখানো হয়েছে ১১/৯ /২০২২। রাশিদুল বলেন অন্যদের গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের বীজ বিতরণের প্রায় এক মাস পরে আমাদের কয়েকজনের বীজ দেওয়া হয়েছে। একটি খেতেও কোন প্রদর্শনী সাইনবোর্ড পাওয়া গেল না। কৃষক সুমনের যে খেতে রসুন এর প্রদর্শনী করা হয়েছে সে ক্ষেত মাত্র ১৭ শতক জমি হবে কিন্তু প্রদর্শনী সাইনবোর্ডে ৩৩ শতক জমি লেখা হয়েছে।
এই প্রসঙ্গে সাধুহাটি ইউনিয়নের উপসহকারী কৃষি অফিসার মিলন ঘোষের সাথে কথা বললে সে বলে যে সব পেঁয়াজ সঠিকভাবে চাষ হয়েছে এবং পেঁয়াজ উঠায় কৃষকেরা বিক্রয় করে ফেলেছে বলে কৃষকের ক্ষেতে কোন পেঁয়াজ দেখা যায়নি। যে অঞ্চলে পেঁয়াজ ভালো হয় সেই অঞ্চলেই চাষীদের গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের বীজ বিতরণ করা হয়েছে বলে সে দাবি করেন। তার কাছে জানতে চাওয়া হয় যে এই পেঁয়াজের মেয়াদকাল কত দিনের? প্রতিউত্তরে সে জানাই ১০০ থেকে ১২০ দিন। তখন তার কাছে বর্তমানে জমিতে পেঁয়াজ নাই কেন জিজ্ঞাসা করলে সে বলে যে সাংবাদিকদের সাথে আমাদের এই বিষয়ে কথা বলা নিষেধ আছে। আপনারা আমার স্যার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জাহিদুল করিমের সাথে যোগাযোগ করে কথা বলতে পারেন।
সদর উপজেলার দোগাছি ইউনিয়নে পাওয়া যায় সাধুহাটি ইউনিয়নের উল্টো চিত্র। পন্ডিত পুর গ্রামের সাতজন কৃষক তারা তাদের জমিতে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের চারা রোপন করেছে সবেমাত্র ১৫-২০ দিন হল। তবে পুটিয়া গ্রামের সজীব নাম করে একজন কৃষকের গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের বীজ বিতরণ করেছে। সে মুরগির ব্যবসা করে তার এক বিঘা জমি বন্ধক রেখে গমের চাষ করেছে। তার কোন পেঁয়াজের চাষ নাই। তাছাড়া কলমান খালি গ্রামের এক মহিলাকে পেঁয়াজ চাষী সাজিয়ে তাকে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের প্রণোদনা বিতরণ করেছে। সে প্রকৃতপক্ষে কোন কৃষক নয় । সে অত্র ইউনিয়নের উপসহকারী কৃষি অফিসারের বাচ্চা রাখেন। সেই সুবাদে তাকে এই গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের প্রণোদনা দেয়া হয়েছে।
এই প্রসঙ্গে দোগাছি ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান কাজল জানান এই ইউনিয়নের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা তার যাদের সাথে সম্পর্ক ভালো শুধু তাদেরকেই বিভিন্ন প্রকার সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকেন। আমি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হলেও কৃষকের ব্যাপারে আমার সাথে কোন পরামর্শ করা হয় না। যার কারণে যারা প্রকৃত কৃষক তারা অনেকেই কৃষি বিভাগের বিভিন্ন প্রকার সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
এই প্রসঙ্গে দোগাছি ইউনিয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা কুহেলি বিশ্বাস এর সাথে কথা বললে সে বলে যে কোন প্রকার অনিয়ম স্বজনপ্রীতি এখানে ঘটেনি প্রকৃত কৃষকদেরই পেঁয়াজের প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। চেয়ারম্যানের পরামর্শই তা হয়েছে বলে সে দাবি করেন। সে বলে যে ধান কাটার পরে আমার কৃষকেরা গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের চাষ করেছে ।তাই এখনো তাদের পেয়াজ মাঠে রয়েছে। এই পিয়াজ আরো দেড় দুই মাস পর কৃষক তুলতে পারবে বলে সে দাবি করেন।
এই প্রসঙ্গে ঝিনাইদহ সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জাহিদুল করিমের সাথে কথা বললে সে বলে নিয়ম মোতাবেক যথাযথ সময়ে কৃষকের মাঝে পেঁয়াজের প্রণোদনা বিতরণ করা হয়েছে। এতদিনে কৃষকের মাঠে আর গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ নেই বলেন জানান।