ব্যাংকের করপোরেট সামাজিক কার্যক্রম (করপোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিটিলি-সিএসআর) বাবদ ব্যয়ের ৩০ শতাংশ অর্থ খরচের নির্দেশনা রয়েছে শিক্ষা খাতে। অথচ এ খাতে এক টাকাও ব্যয় করেনি ২৭টি ব্যাংক। বাকি ব্যাংকগুলোও ব্যয় করেছে নামমাত্র। শিক্ষা ছাড়া সিএসআরভুক্ত অন্যান্য খাতে ব্যয় হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সেসব বিষয়ে এখনো কোনো প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি।সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘদিন থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এ খাতে ব্যাংকের সিএসআরের অনুদান কমে এসেছে। তা ছাড়া ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ব্যয় করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ নির্দেশনা ছিল করোনাকালীন সময়ে। সে কারণেও এমনটি হয়ে থাকতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে ৬০টি ব্যাংকের মাধ্যমে শিক্ষা খাতে মাত্র ২৩ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এর মধ্যে ২৭টি ব্যাংকের ব্যয় শূন্য। ১৯টি ব্যাংকের শিক্ষায় ব্যয় লাখের ঘরে সীমাবদ্ধ। কোটির ঘর অতিক্রম করেছে মাত্র আটটি ব্যাংক। যেসব ব্যাংক শিক্ষা খাতে কোনো অর্থ ব্যয় করেনি সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক। এ ছাড়া এ তালিকায় সরকারি আরও দুটি ব্যাংকের নাম রয়েছে। সরকারি বিশেষায়িত খাতের বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক এবং প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকও কোনো অর্থ ব্যয় করেনি শিক্ষা খাতে। বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ কমার্স, কমিউনিটি, আইসিবি ইসলামিক, আইএফআইসি, মেঘনা, এনআরবি কমার্শিয়াল, গ্লোবাল ইসলামী, ওয়ান, পদ্মা, সীমান্ত, ট্রাস্ট, উত্তরা ও চলতি বছরে কার্যক্রমে আসা বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক।
বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে ব্যাংক আল-ফালাহ, কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলন, সিটি ব্যাংক এনএ, হাবিব ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান (এনবিপি), স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক এবং দক্ষিণ কোরিয়ার উরি ব্যাংক এক টাকাও ব্যয় করেনি শিক্ষা খাতে।
জানা গেছে, টেকসই উন্নয়নের ধারা বজায় রাখতে করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা সিএসআর বা বর্তমান বিশ্বে ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুদান। এটি হলো এক ধরনের ব্যবসায়িক শিষ্টাচার-রীতি বা দায়বদ্ধতা, যা সমাজের প্রতি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালনকে বুঝিয়ে থাকে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে পরিচালিত কার্যক্রমের ফলে উদ্ভূত নানারকম পরিবেশগত বিরূপ প্রভাব দূর এবং সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে বিদ্যমান ক্ষোভ, অসমতা ও দারিদ্র্যতা কমানো সিএসআরের প্রধান লক্ষ্য। ২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো প্রজ্ঞাপন জারি করে সিএসআর খাতে ব্যয় করার দিকনির্দেশনা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। পরবর্তীতে একাধিকবার প্রজ্ঞাপন জারি এবং ব্যয়ে খাত নির্ধারণ ছাড়াও এ সংক্রান্ত আইন যথাযথভাবে প্রয়োগের জন্য বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ, আয় উৎসাহী কার্যক্রম, অবকাঠামো এবং সংস্কৃতি খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে সিএসআরের অর্থ ব্যয় করতে নির্দেশনা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্প্রতি করোনা মহামারিতে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভঙ্গুর পরিস্থিতি উন্মোচিত হলে স্বাস্থ্য খাতে সিএসআর ব্যয় বাড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নির্দেশনা জারি করা হয়।
বর্তমানে ব্যাংকগুলোর মোট সিএসআর ব্যয়ের ৬০ শতাংশই স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের নির্দেশনা রয়েছে। বাকি ৪০ শতাংশের মধ্যে ৩০ শতাংশ শিক্ষা এবং ১০ শতাংশ অন্যান্য খাতে ব্যয় করতে বলা হয়েছে। ব্যাংকগুলোর
সিএসআর খাতের ব্যয়ের দিকটি দেখাশোনা করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাসটেইনেবল ফাইন্যান্স বিভাগ। সংশ্লিষ্ট বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংকগুলোর কর-পরবর্তী নিট মুনাফা থেকে সিএসআর খাতে ব্যয়ের নির্দেশনা রয়েছে। তবে সিএসআর খাতে ব্যয় করতেই হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তবে যেসব ব্যাংক বিধি অনুযায়ী সিএসআর খাতে ব্যয় করে সেসব ব্যাংকের সার্বিক মানন্নোয়ন রেটিং বা প্রচলিত সংক্ষিপ্ত নাম হিসাবে ‘ক্যামেলস রেটিং’ সমৃদ্ধ হয়।
ব্যাংকগুলো কোন খাতে সিএসআরের কত শতাংশ ব্যয় করছে বা করবে, তা সময়ে সময়ে নির্দেশনার মাধ্যমে জানিয়ে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মানন্নোয়নের এই রেটিং একটি ব্যাংকের জন্য খুবই প্রয়োজনীয় বিষয়।
জানতে চাইলে সাসটেইনেবল ফাইন্যান্স বিভাগের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) খন্দকার মোর্শেদ মিল্লাত শনিবার যুগান্তরকে বলেন, ‘উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানগুলো সিএসআরের ৬০ শতাংশ যদি করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ব্যয় করে থাকে তবে শিক্ষায় না দিলেও দোষের কিছু হবে না। বিষয়টি সরল দৃষ্টিতে বিবেচনা করব। কিন্তু যথাযথভাবে সিএসআর খাতে ব্যয় না করলে ব্যাংকগুলো ক্যামেলস রেটিংয়ে প্রাপ্য জবাব পেয়ে যাবে। অর্থাৎ তাদের রেটিং খারাপ হবে।’
জানা গেছে, প্রতিটি ব্যাংক বছর শেষে লাভ ক্ষতির হিসাব চূড়ান্ত করে লাভের অংশ থেকে সিএসআর খাতে বরাদ্দ নির্ধারণ করে। এ ক্ষেত্রে আইন দ্বারা কোনো অর্থের পরিমাণ নির্ধারণ করে দেওয়া নেই। ব্যাংক তার সামর্থ্য ও সদিচ্ছা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।