শুক্রবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:৪৮ পূর্বাহ্ন

সন্তোষ দাস কে দেবার মত কোন সন্তোষজনক কোন উত্তর আছে কি?

সম্পাদকীয় / ৪৯১ বার এই সংবাদটি পড়া হয়েছে
প্রকাশের সময় : শনিবার, ২০ আগস্ট, ২০২২

সন্তোষ দাস কে দেবার মত কোন সন্তোষজনক কোন উত্তর আছে কি?

গানটা বোধ হয় সবাই শুনেছেন ” বাবু বলে কাম কাম সদ্দার বলে নিবো গায়ের চাম ও বাবুরে ফাকি দিয়ে চালাইলি আসাম ” সকালে বিকালে নানা কাজে চা না হলে চলেই না। দুটি পাতা একটি কুড়ির চা পাতার জীবনে যাপিত মানুষ গুলোর রং চায়ের মত রং নেই, স্বপ্ন নেই, বিবর্ণ আটপৌরে সাদা মাটা জীবন। এখন তাদের সারাদিনের ঘামের মুল্য ১২০ টাকা।

এদেশের মানুষের জীবন মান নিয়ে গোল টেবিলে বসে চা চক্র করা সুশীল সমাজের মানুষরাও হয়তো কল্পনা করতে পারবে না এদের মানবতার জীবনের কথা। হয়তো তারা রাস্তায় নেমে আসে না, আজকের মত মানে ১৭ ই আগষ্টের মত সারা চা বাগানে একযোগে বোমা হামলা করে না। এরা হয়তো মতিঝিল অবরোধ করে না হয়তো লগি বৈঠার মিঠিল করে না। কিন্তু ক্ষুধার কষ্ট বোধ করি আমাদের মতই অনুভব করে। অভিজাত পাড়ার পাস দিয়ে হেটে গেলে একটা ভালো খাবারের গন্ধ নাকে এলে বোধ করি এরাও আপন মনে বলে উঠে হায় ভগবান হামাক পেল দিলি কিন্তুক তা ভরবার ল্যাইগ্যে দিলিক লয়। হাজার টাকার বালিশের দেশে কে শুনবে ওদের নালিশ। হলমার্ক পিকে হাল দারের দেশে কে করবে ওদের শালিশ। এদের একজন গোবরে ফোটা পদ্ন সন্তোষ রবিদাস অঞ্জন। তার মা কে লিখেছেন।

মৌলভীবাজার জেলার শমসেরনগরে ফাঁড়ি কানিহাটি চা-বাগানের এক চা শ্রমিক পরিবারের ছেলে আমি। জন্মের ছয় মাসের মাথায় বাবাকে হারিয়েছি। মা চা-বাগানের শ্রমিক। তখন মজুরি পেতেন দৈনিক ১৮ টাকা।সেই সময় আমাকে পটের দুধ খাইয়ে, অন্যের বাসায় রেখে মা যেতেন বাগানে কাজ করতে।(সকাল থেকে সন্ধা অবধি কাজ করতেন সন্তোসের মা)
২০০৭ সালে আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি। মায়ের মজুরি তখন ৮৮ টাকা। এক দিন বললেন, ‘বাজারে গিয়ে পাঁচ কেজি চাল নিয়ে আয়।’ সেই চাল দিয়ে এক মাস চলেছে আমাদের। পরদিন সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে দেখি মা চাল ভাজলেন। পলিথিনে সেই ভাজা চাল, আটার রুটি আর লাল চা একটা বোতলে ভরে গামছায় প্যাঁচালেন।

আর আমাকে আটার রুটি ও লাল চা দিলেন। দুপুরে খেতে গিয়ে দেখি শুধু পেঁয়াজ, শুকনা ভাত, তেল আর লবণ আছে। তা দিয়ে মেখে খেলাম। রাতেও কোনো তরকারি ছিল না। তখন পাশের বাসার কাকু আমাকে ডেকে কুমড়া আর আলু দিয়েছিলেন, যা দিয়ে আমরা দুইটা দিন পার করেছিলাম। তখন কুপি বাতির আলোয় পড়তাম। মা আগেই রেডি করে দিতেন বাতি। তেল শেষ হয়ে গেলে আর পড়া হতো না। দোকানদার বাকিতে তেল দিতেন না।(দোকাদারের মনে ভয় এই চায়ের পাতা তোলা শ্রমিক টাকায় বা দিবে কিভাবে)
পঞ্চম শ্রেণির পর ভর্তি পরীক্ষায় পাস করে ক্যামেলিয়া ডানকান ফাউন্ডেশন স্কুলে পাঁচ বছরের জন্য ফ্রি পড়ালেখার সুযোগ পাই।

মা অনেক খুশি হয়েছিলেন। তখন তাঁর সামান্য আয়ের একটা অংশ থেকে আমাকে টিফিন খাওয়ার জন্য প্রতি সপ্তাহে ৭০-৮০ টাকা দিতেন। ২০১৩ সালে বিএএফ শাহীন কলেজে ভর্তি হই। তখন মা ১০২ টাকা করে পেতেন। এই সময়ে তিনি গ্রামীণ ব্যাংক থেকে কিস্তি তুলে আমার ভর্তির টাকা, ইউনিফর্ম আর বই-খাতা কিনে দিয়েছিলেন। ২০১৪ ডিসেম্বর। মায়ের হাতে টাকা নেই। তখন এইচএসসির রেজিস্ট্রেশন চলছিল। মা ৫০ টাকার একটা নোট দিয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলেছিলেন, ‘কেউ ধার দেয়নি রে বাপ।’ কলেজের এক শিক্ষকের কাছ থেকে ধার নিয়ে সেবার রেজিস্ট্রেশন ফি দিয়েছিলাম।

এইচএসসির পর ভর্তি পরীক্ষার কোচিং। মা তখন আবার লোন নিলেন গ্রামীণ ব্যাংক থেকে। লোনের কিস্তির জন্য এই সময় মা বাড়ি থেকে অনেক দূরে গিয়ে বালু শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। বিনিময়ে পেতেন ৩০০ টাকা। আমি জানতাম ঘরে চাল নেই। শুধু আলু খেয়েই অনেক বেলা কাটিয়েছিলেন মা।
এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেলাম। মা তখন কী যে খুশি হয়েছিলেন! কিন্তু ভর্তির সময় যত ঘনিয়ে আসছিল, মায়ের মুখটা তত মলিন দেখাচ্ছিল। কারণ চা-বাগানে কাজ করে যা পান তা দিয়ে তো সংসারই চলে না। ভর্তির টাকা দেবেন কোথা থেকে। পরে এলাকার লোকজন চাঁদা তুলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে সহায়তা করল বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশনি করেই চলতাম। হলের ক্যান্টিনে ২০ টাকার সবজি-ভাত খেয়েই দিন পার করেছি। অনেক দিন সকালে টাকার অভাবে নাশতাও করতে পারিনি। দুর্গাপূজায় কখনো একটা নতুন জামা কিনতে পারিনি।

২০১৮ সালে শ্রেষ্ঠ মা হিসেবে উপজেলায় মাকে সম্মাননা দেওয়া হবে বলে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জানানো হয়। পরে মায়ের নামটা কেটে দেওয়া হয়েছিল। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, মা আমার চা শ্রমিক। স্টেজে উঠে নাকি কিছু বলতে পারবেন না। তাই নাম কেটে দিয়েছে! মা এখনো প্রতিদিন সকালে একটা বোতলে লবণ, চা-পাতা ভর্তা, আটার রুটি, সামান্য ভাত পলিথিনে ভরে নিজের পাতি তোলার গামছায় মুড়িয়ে নিয়ে দৌড়ান চা-বাগানে। আট ঘণ্টা পরিশ্রম করে মাত্র ১২০ টাকা মজুরি পান! এই মজুরিতে কিভাবে চলে একজন শ্রমিকের সংসার? আজকাল মায়ের শরীর আর আগের মতো সায় দেয় না। বলেন, ‘তোর চাকরি হইলে বাগানের কাজ ছেড়ে দেব।’ আমি এখন সেই দিনের প্রতীক্ষায় আছি….!-সন্তোষ রবিদাস অঞ্জন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

একজন সন্তোষের কথা বলতে পারলাম। সে তার সবটা বলেনি। সবটা বলা যায় না। রাগিব আলিদের আলিসান বাড়ি হয় আর আমি বড্ড বহায়র মত আতিক কে বলি আর এক কাপ চা দিস তো বাপ। সবাই লাল চা বলতো আমি বলতাম খয়েরী চা। এখন বুঝি চায়ের রং আসলেই লাল কারন শ্রমিকের গায়ে আমার আপনার মত লান রক্ত প্রবাহিত। অনেকক্ষণ ভেবেও সন্তোষ কে দেবার মত কোন সন্তোষজনক উত্তর পেলাম না।

বেদুইন হায়দার লিও
সাবেক সদস্য সচিব
তেল গ্যাস বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ